মুসলিম বিশ্বের একটি পবিত্রময় রাত হচ্ছে শবে বরাত। এই রাতে আল্লাহ তায়ালা সকল বান্দারের উপর রহমত দান করে। আসমান থেকে জমিনে ফেরেশতা পাঠানো হয় বান্দাদের দুঃখ- কষ্ট জানার জন্য। সকল বান্দা এই রাতে নামাজ, আমল ও ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে আল্লাহর সাথে যোগাযোগ ও শামিল স্থাপন করে। শবে বরাতের ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিস আছে। যা আগের যুগেও পালিত হয়েছে। এবং বর্তমানে পালন করা হচ্ছে।
তবে এখন কিছু ভুল হাদিস মনের অজান্তে পালন করা হয়। এজন্য একজন মুসলিম হিসেবে সেগুলো জানতে হবে। এই রাতের ফজিলত ও লাভ সমূহ জেনে আমল করতে হবে। শবে বরাতের করনীয় ও বর্জনিয় কাজ গুলো কি কি সেগুলো জানতে হবে। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঁঃ) যেভাবে শবে বরাত পালন করতে, ঠিক সেভাবে তার উম্মত হিসেবে আমাদের পালন করতে হবে। নিচে এর ফজিলত ও আমল, গুরুত্ব ও ইবাদত সম্পর্কে বিস্তারিত দেওয়া আছে।
শবে বরাতের ফজিলত
এটি একটি বরকতময় রাত। যার কারণে সারা বিশ্বের মুসলিম এই রাতে ইবাদত-বন্দেগী করে। নামাজ, দোয়া-দরুদ ও কুরআন পাঠের মাধ্যমে শবে বরাত পালন করা হয়। প্রতিটি আমলের গুরুত্ব ও ফজিলত আছে। প্রায় মুসলিম আমল করলেও, শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে জানে না। তাই এই আমলের ফজিলত কি কি তা জেনে সঠিক ভাবে আমল করতে হবে। আল্লাহুম্মা বারিকলানা-ফি শাবান ওয়া বাল্লিগনা- রামাদান। এই দোয়াটি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শেখানো দোয়া। সেই সময়ে সাহাবিগণ সব সময় পাঠ করতেন। আমরাও দোয়া টি পাঠ করার চেষ্টা করব।
শবে বরাতের অসাধারণ ফজিলত:
১. রহমতের বর্ষণ: এই রাতে আল্লাহ তা’আলা তাঁর অশেষ রহমত বর্ষণ করেন। বান্দাদের পাপ ক্ষমা করেন, দোয়া কবুল করেন এবং নেকীর বিনিময়ে প্রচুর সওয়াব দান করেন।
২. ভাগ্য নির্ধারণ: এই রাতে আগামী এক বছরের ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করা হয়। বান্দাদের রিযিক, জীবন-মৃত্যু, সুখ-দুঃখ সবকিছু এই রাতেই নির্ধারিত হয়।
৩. ক্ষমার সুযোগ: এই রাতে আল্লাহ তা’আলা ক্ষমাশীলতার দরজা উন্মুক্ত করে দেন। মুশরিক ও বিদ্বেষপূর্ণ ব্যক্তি ছাড়া সকলের জন্য ক্ষমা লাভের সুযোগ থাকে।
৪. নফল ইবাদতের ফজিলত: এই রাতে নফল ইবাদতের ফজিলত অনেক বেশি। রাত জেগে ইবাদত, তেলাওয়াত, দোয়া, জিকির-আজকার করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা সম্ভব।
৫. লাইলাতুল কদরের সম্ভাবনা: শবে বরাতকে লাইলাতুল কদরের অন্যতম সম্ভাব্য রাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই রাতে লাইলাতুল কদরের فضیلت লাভের আশায় অনেকে রাত জেগে ইবাদত করেন।
৬. পূর্বপুরুষদের জন্য দোয়া: এই রাতে পূর্বপুরুষদের জন্য দোয়া করার বিশেষ ফজিলত রয়েছে। তাদের জন্য দোয়া করলে তাদের গুনাহ মাফ হতে পারে এবং তারা আল্লাহর রহমত লাভ করতে পারেন।
৭. সামাজিক সম্প্রীতি: এই রাতে একে অপরের সাথে সিলা-রহিম বজায় রাখা, ক্ষমা চাওয়া, এবং সাহায্য-সহযোগিতা করার মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রীতি বৃদ্ধি করা সম্ভব।
৮. আত্ন-পরিশোধন: এই রাতে নিজের ভুল-ত্রুটি পর্যালোচনা করে আত্ন-পরিশোধন করার সুযোগ। গোনাহ থেকে তওবা করে নতুন জীবন শুরু করার প্রত্যয় নেওয়া উচিত।
৯. শুকরিয়া জ্ঞাপন: এই রাতে আল্লাহ তা’আলার অশেষ রহমত, অনুগ্রহ এবং নিয়ামতের জন্য শুকরিয়া জ্ঞাপন করা উচিত।
১০. দোয়া ও প্রার্থনা: এই রাতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং জাতীয় কল্যাণের জন্য দোয়া ও প্রার্থনা করা উচিত।
উল্লেখ্য শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে বিতর্কিত কিছু হাদিসও রয়েছে। তাই সহীহ হাদিসের আলোকে এই রাতের আমল করা উচিত। রাত জেগে ইবাদত করার পাশাপাশি দিনের বেলায়ও নেক কাজের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার চেষ্টা করা উচিত।
শবে বরাতের ফজিলত ও গুরুত্ব
শাবান মাস বরকতের মাস। রাসূল (সাঃ) এ মাসে সবচেয়ে বেশি নফল রোজা রাখতেন। হজরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসূল (সাঃ) রমজান ব্যতীত অন্য কোনো মাসে পূর্ণ রোজা রাখতেন না এবং শাবান মাসের চেয়ে অন্য কোনো মাসে এতো বেশি রোজা রাখতেন না। (সহিহ বোখারি ও মুসলিম)
অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত উসামা ইবনে জায়েদ (রাঃ) বলেন, আমি একদিন রাসূল (সাঃ)-এর খেদমতে আরজ করলাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি আপনাকে শাবান মাস ব্যতীত অন্যকোনো মাসে এতো অধিক পরিমাণে রোজা রাখতে দেখিনি। হজরত রাসূল (সাঃ) বললেন, এটা ওই মাস যে মাস সম্পর্কে অধিকাংশ লোকই গাফেল থাকে। এটা রজব ও রমজান মাসের মধ্যবর্তী মাস। এটা এমন মাস, যে মাসে মানুষের আমলসমূহ আল্লাহতায়ালার দরবারে পেশ করা হয়। আমার আকাঙ্ক্ষা যে, আমার আমল আল্লাহতায়ালার দরবারে এ অবস্থায় পেশ হোক যে, আমি রোজাদার। (নাসায়ি ও শোয়াবুল ঈমান)
শাবান মাসের ফজিলত সম্পর্কে বিভিন্ন সহিহ হাদিসের কিতাবে অসংখ্য বর্ণনা রয়েছে। যার দ্বারা এ মাসের ফজিলত ও গুরুত্ব প্রমাণিত হয়। সুতরাং এ মাসে রোজা রাখা প্রমাণিত বিষয়। শবে বরাত শব্দটি ফারসি। শব শব্দের অর্থ রাত আর ‘বরাত’ অর্থ নাজাত, মুক্তি রক্ষা ইত্যাদি। এ রাতে যেহেতু গোনাহগারের গোনাহ মাফ হয় এবং অসংখ্য অপরাধীর অপরাধ ক্ষমা করা হয়, সেহেতু এ রাত মুসলমানদের মাঝে ‘শবে বরাত’ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে।
শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস
এই সম্পর্কে অনেক হাদিস আছে। এই হাদিস গুলো আমাদের জানতে হবে। শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে সেরা কয়েকটি হাদিস নিচে দেওয়া আছে। হাইদস গুলো পড়ে শবে বরাত সম্পর্কে আরও জানতে পারবেন।
১. মুআজ ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা অর্ধ শাবানের রাতে বান্দাদের দিকে তাকান এবং মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন।” (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)
২. আবু মুসা আল-আশ’আরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর বান্দাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকান এবং ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ দান করেন এবং বিদ্বেষপোষণকারীদের তাদের অবস্থায় ছেড়ে দেন।” (ইবনে মাজাহ)
৩. আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অর্ধ শাবানের রাতে নামাজে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি ভাবলাম, হয়তো beliau রাত জাগিয়ে কাটাবেন। অতঃপর beliau রুকুতে গেলেন এবং দীর্ঘক্ষণ রুকুতে রইলেন। আমি ভাবলাম, হয়তো beliau রুকুতেই রাত কাটাবেন। অতঃপর beliau সিজদায় গেলেন এবং দীর্ঘক্ষণ সিজদায় রইলেন। আমি ভাবলাম, হয়তো beliau সিজদায়ই রাত কাটাবেন।” (মুসলিম)
৪. সাহল ইবনে সাদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত:
তিনি বলেছেন, “রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অর্ধ শাবানের রাতে আমাদেরকে বেরিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন এবং আমাদের সাথে নামাজ পড়লেন।” (আবু দাউদ)
শবে বরাতের ফজিলত ও আমল
শবে বরাতের রাত জাগা ইবাদতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই রাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নামাজ, তেলাওয়াত, দোয়া ও জিকিরে মশগুল থাকতেন। রাত জাগার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ্র রহমত ও বরকত লাভ করতে পারি। রাত জেগে যেকোনো ইবাদতের মাধ্যমে শবে বরাত পালন করা যাবে।
- এই রাতে অধিক নামাজ পড়া উচিত।
- পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করা । সম্পূর্ণ কোরআন তেলাওয়াত করতে না পারলে, কিছু অংশ তেলাওয়াত করা উচিত।
- এই রাতে আল্লাহ্র কাছে দোয়া ও জিকির করা উচিত। ক্ষমা, রহমত, বরকত, জান্নাত প্রাপ্তি, এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সুখের জন্য দোয়া করা উচিত।
- গোনাহের জন্য তওবা ও ইস্তেগফার করা উচিত।
- এই রাতে দান-খয়রাত করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা এবং তাদের জন্য দান করা উচিত।
- শবে বরাতের রাতে বিশেষ কোনো নামাজ বা ইবাদত নেই।
- এই রাতে অলীক রীতিনীতি ও কুসংস্কার থেকে দূরে থাকা উচিত।
- ইসলামের আলোকে এই রাতের আমল করা উচিত।
শেষ কথা
শবে বরাত, বরকতের রজনী, ক্ষমা ও রহমতের রাত। আল্লাহ তাআলা এ রাতে বান্দাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকান। এই রাতে যেকোনো ইবাদত করা যাবে। এই ইবাদতের মাধ্যমে ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। সকল মুসলিমদের শবে বরাতের ইবাদত করতে হবে। আশা করছি শবে বরাতের ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিস জানতে পেরেছেন।
আরও দেখুনঃ