প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে মাতৃভাষা দিবস উদযাপন করা হয়। একে ভাষা শহিদ দিবস বা অমর একুশেও বলা হয়। এই অমর একুশের পিছনে রয়েছে নানা ইতিহাস। যেই ইতিহাস গুলো বিভিন্ন কবিতা একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতা লিখার মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। মাতৃভাষার প্রতি মর্যাদা বাংলার দামাল ছেলেদের কে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করেছে। যার উদাহরণ স্বরূপ অনেক বাঙালি ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে। আজকে তাদের নিয়ে সিকান্দার আবু জাফরের ২১শে ফেব্রুয়ারির কবিতা, ছোটদের কবিতা আবৃতি, অমর ২১ শের কবিতা ও আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো কবিতা গুলো সংগ্রহ করে দেওয়া হয়েছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতা
কবিতা পড়লে মানুষের মন ভালো থাকে। এছাড়া এমন অনেক কবিতা আছে, যেগুলো পড়লে পূর্বের বিভিন্ন ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা যায়। এই ধরনের কবিতার মধ্যে হচ্ছে অমর একুশের কবিতা। যে কবিতায় কবি ভাষা আন্দোলন ও মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস ফুটিয়ে তুলেছে। এখানে দেওয়া একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতা পড়ার মাধ্যমে ২১ শে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে জানতে পারবেন। এখানে সেরা কয়েকটি কবিতা দেওয়া আছে।
অমর একুশে
হাসান হাফিজুর রহমান
আম্মা তাঁর নামটি ধরে একবারও ডাকবে না তবে আর?
র্ঘূূণি ঝড়ের মতো সেই নাম উম্মথিত মনের প্রান্তরে
ঘুরে ঘুরে জাগবে, ডাকবে,
দুটি ঠোঁটের ভেতর থেকে মুক্তোর মতো গড়িয়ে এসে
একবারও উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না, সারাটি জীবনেও না? তবে হার?
কি করে এই গুরুভার সইবে তুমি, কতোদিন?
আবুল বরকত নেই: সেই অস্বাভাবিক বেড়ে ওঠা
বিশাল শরীর বালক, মধুর স্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতো যে
তাঁকে ডেকো না;
আর একবারও ডাকলে ঘৃণায় তুমি কুঁচকে উঠবে-
সালাম, রফিক উদ্দিন, জব্বার-কি বিষণ্ন থোকা থোকা নাম;
এই এক সারি বর্শার তীক্ষ ফলার মতো এখন হৃদয়কে হানে
বিচ্ছেদের জন্য তৈরী হওয়ার আগেই
আমরা ওদেরকে হারিয়েছি-
কেননা, প্রতিক্রিয়ার গ্রাস জীবন ও মনুষ্যত্বকে সমীহ করে না;
ভেবে ওঠার আগেই আমরা ওদেরকে হারিয়েছি
কেননা, প্রতিক্রিয়ার কৌশল এক মৃত্যু দিয়ে হাজার মৃত্যুকে ডেকে আনে।
আর এবার আমরা হারিয়েছি এমন কয়েকজনকে
যাঁরা কোনদিন মন থেকে মুছবে না,
কোনদিন কাউকে শান্ত হতে দিবে না;
যাঁদের হারালাম তাঁরা আমাদেরকে বিস্তৃত করে দিয়ে গেল
দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, কথা কণা করে ছড়িয়ে দিয়ে গেল
দেশের প্রাণের দীপ্তির ভেতরে মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে।
একুশের কবিতা
আল মাহমুদ
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ?
বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে
জ্বলবে এমন লাল যে,
সেই লোহিতেই লাল হয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে !
প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে
তিতুমীরের কন্যা।
চিনতে না কি সোনার ছেলে
ক্ষুদিরামকে চিনতে ?
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে
মুক্ত বাতাস কিনতে ?
পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়
ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,
ফেব্রুয়ারির শোকের বসন
পরলো তারই ভগ্নী।
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন, আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।
একটি গানের কবিতা
যে ভাষাতে সহজ করে কথা বলি উচ্ছ্বাসে —
সেইতো আমার প্রাণের ভাষা
সেইতো আমার মায়ের ভাষা
বুক ভরে নিঃশ্বাসে।।
মা ডাকি ভাই যখন শোন নেচে ওঠে প্রাণ,
এই ভাষাতে লিখন লিখি কাব্যের আয়োজন।
বাঙলাতে যে হৃদয় ভরে – বাংলা মায়ের ঘরে ঘরে
ঝরে আনন্দ বিশ্বাসে।।
যে ভাষা আজ হৃদয় জুড়ে বিশ্বে পেল ঠাঁই,
এই ভাষাই মায়ের বুলি আর কি বল চাই।
মাতৃ ভাষাই মায়ের বানী – জন্ম হতেই তাই জানি
থাকি কাছে কি নির্বাসে।।
একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতা 2024
কবিতা শুরু:
শহীদদের রক্তে রাঙা,
আমাদের এই ভাষা,
এ ভাষার জন্য আজ,
প্রাণ দিলো কত যুবা।
বুকের রক্তে লিখেছিল,
ভাষার মর্যাদা,
সেই রক্তের লেখা আজ,
অমলিন হবে না কখনো।
একুশে ফেব্রুয়ারি,
আমাদের গর্বের দিন,
এই দিনে আমরা,
শহীদদের বলিদান স্মরণ করি।
তাদের আত্মত্যাগ,
কখনো ভোলা যাবে না,
তাদের স্মৃতি,
চিরকাল আমাদের হৃদয়ে থাকবে।
ভাষা আমাদের অধিকার,
এ অধিকার রক্ষা করতে,
আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই।
২১ শে ফেব্রুয়ারি,
শুধু একটি দিন নয়,
এটি আমাদের সংস্কৃতি,
এবং ঐতিহ্যের দিন।
এই দিনে আমরা,
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাই,
এবং তাদের আদর্শ ধারণ করে,
আমাদের জীবনকে গড়ে তুলি।
বাংলা ভাষা আমাদের গর্ব,
এই ভাষাকে আমরা,
চিরকাল সমৃদ্ধ করবো।
২১ শে ফেব্রুয়ারি,
একটি অমর দিন,
এই দিন আমাদের,
স্মরণে থাকবে চিরকাল।
আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতা
আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি।।
জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।
সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকনন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো।।
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি।।
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু
গড়ায়ে ফেব্রুয়ারী।।
আমার সোনার দেশের
রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী।।
ভাষার জন্য
হাজার ভাষার ভিড়ে তুমি অনন্য,
বাংলায় কথা বলতে পেরে মোর এ জীবন ধন্য।
তোমাকে পাওয়ার জন্য,
কত বাঙালি রক্ত দিলো,
রক্ষা করতে তোমার ঐ স্বর্ণময় বর্ণ।
যে বুঝেনি তোমার মধুরতার মর্ম,
সে বাঙালি নয়, দেহে তার ভিন ভাষীদের রক্ত।
মা বোলে মুখ খুলেছি,
মায়ের আদর মাখা কণ্ঠ তোমাতে পেয়েছি।
আহা কি তৃপ্তি, এই ভাষায় কথা বলাতে,
হৃদয় জাগে তারই বোলেতে।
একুশ তোমায় সম্মান জানাই ফেব্রুয়ারিতে,
বাংলা ভাষা এনে দিলে মোরে,
মাথা নত হয়ে আসে এই খুশিতে।
মাগো, আবার কেউ যদি আসে
কেড়ে নিতে তোর মুখের বোল ,
বুক পেতে বইয়ে দিবো মা,তাজা রক্তের ঢল।
বাংলায় হাসবো, বাংলায় গাইবো,
প্রয়োজনে তারই জন্য অস্ত্র ধরবো।
সালাম তোমায় বাংলা ভাষা,
তোমার জন্য বুকে বাঁধি মোদের ভালবাসা।
সিকান্দার আবু জাফরের “একুশে ফেব্রুয়ারি” কবিতা
শহীদের রক্তে রাঙা
এই দিন অমর
ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল
বাঙালির সোনার ছেলে
বুকে লাল গোলাপ ফুটে
ছিল তাদের হাতে
স্বাধীনতার গান গেয়ে
ছুটেছিল তারা রণক্ষেত্রে
গুলির বর্ষণে ঝরে গেল
অনেক প্রাণ
তবুও থেমে থাকেনি
ভাষার আন্দোলন
স্বাধীনতার সূর্য উঠেছে
আজ বাংলার আকাশে
ভাষার শহীদদের
ত্যাগ বৃথা যায়নি
এই দিন আমরা স্মরণ করি
তাদের বलिদান
ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি
আমরা বাংলা ভাষা
কে প্রাণের চেয়েও বেশি
ভালোবাসবো
এবং
স্বাধীন বাংলাদেশকে
সোনার বাংলা করে তুলবো
একুশের কবিতা
– মহাদেব সাহা
ভিতরমহলে খুব চুনকাম, কৃষ্ণচূড়া
এই তো ফোটার আয়োজন
বাড়িঘর কী রকম যেন তাকে হলুদ অভ্যাসবশে চিনি,
হাওয়া একে তোলপাড় করে বলে, একুশের ঋতু!
ধীরে ধীরে সন্ধ্যার সময় সমস্ত রঙ মনে পড়ে, সূর্যাস্তের
লীন সরলতা
হঠাৎ আমারই জামা সূর্যাস্তের রঙে ছেয়ে যায়,
আর আমার অজ্ঞাতে কারা আর্তনাদ করে ওঠে রক্তাক্ত রক্তিম
বলে তাকে!
আমি পুনরায় আকাশখানিরে চেয়ে দেখি
নক্ষত্রপুঞ্জের মৌনমেলা,
মনে হয় এঁকেবেঁকে উঠে যাবে আমাদের
ছিন্নভিন্ন পরাস্ত জীবন,
অবশেষে বহুদূরে দিগন্তের দিকচিহ্ন মুছে দিয়ে
ডাক দেবে আমরাই জয়ী!
শেষ কথা
কবিরা তাদের কবিতায় ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবলী, ভাষা শহীদদের ত্যাগ ও বलिদান, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ইত্যাদি বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। এই কবিতাগুলো আমাদের মনে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের জ্ঞান জাগিয়ে তোলে। একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতাগুলো আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছে। এই কবিতাগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ভাষা আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তি, স্বাধীনতা আমাদের অধিকার, এবং ত্যাগ ও বलिদানের মাধ্যমেই মহান লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। আশা করছি একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতা গুলো ভালোলেগেছে।
আরও দেখুনঃ
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি কবিতা